আরো লক্ষ বছর পর, যেদিন তোমার আমার দেখা হবে। কে জানে তখন তুমি আমি কোন গ্রহের প্রাণী; তুমি কেমন দেখতে হবে,আর আমারি বা থাকবে কেমন রূপ! তবুও যদি হৃদয়ের দর্পণে আচমকাই ভেসে উঠে বহু শতাব্দী আগে ফেলে আসা এই জন্মের স্মৃতির দৃশ্যপট।
যদি আমাদের পরস্পরে চেনাজানা হয়ে যায় এই জন্মের পরিচয় এবং প্রণয়ের সূত্র ধরে। যদি একে অন্যকে দেখে মুহূর্ত কাল থমকে দাঁড়িয়ে থৈ খোঁজে না পাই কত পূর্বে হয়েছিল শেষ সাক্ষাত দুজনের সেই অতল সময়ের, যদি হঠাৎ করে দুজনের দৃষ্টির সীমানার মাঝখানে এসে দন্ডবৎ হয় মহাকাল, দুপারে কাচের মত নিষ্প্রাণ-স্থীর হয়ে যায় আমাদের দুজোরা চোখ।
যদি হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে যায় উভয়ের,না বলা অনেক কথার মুক্তি পাবার তোরজোড়ে কন্ঠে আটকে থাকে নিঃশ্বাস; আর চোখ বেয়ে নেমে আসে অঝোর অশ্রুধারা, এক অদৃশ্য শেকলের বন্ধনে আটকে যায় আমাদের ব্যাস্ত সমস্ত চারটি পা। তবে তুমি কিছুটা সময় নিও ধাতস্থ হতে,আমিও ঢোক গিলে টুক করে জ্বলা বুকের আগুন টাকে নিভিয়ে নিব। তারপর আমাদের কথা হবে! তোমার হয়তো তখন বয়সের বলি রেখায় কুঁচকানো মুখ, আমার পিঠে মস্ত একটা কুজো।
বুকের পাঁজরে আমার হাঁপরের ওঠা নামা,আর তোমার ঠোঁটে বাসি ফাঁটলের চিহ্ন! তবুও তুমি কষ্ট করে একটা মিষ্টি হাসি দিও, প্রতিউত্তরে আমিও নাহয় অধর যুগল টেনে নিয়ে আসবো কানের কাছাকাছি। তুমি জিজ্ঞেস করো,’ভাল আছো!’ আমি বলবো,আছি তেমন,যেমন তোমাকে ছাড়া থাকা যায়।
শুনে তুমি ভান করো অবাক হওয়ার,পশম বিরল ভ্রূযুগলে ফুঁটিয়ে তুলো বিস্ময়ের কুঞ্চন,পুনর্বার জিজ্ঞেস করো,’মনে পরেনা আমাকে?’ আমি একটা বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসকে মুক্ত করতে করতে তালুর কাছে এনে আটকে দিব, তারপর হবো ভীষণ সাবধানী;যেন বুকের ক্ষতটা তোমার চোখে সাত-তাড়াতাড়ি না পরে যায় সেই চেষ্টায় মুখে ফুঁটাবো তাচ্ছিল্যের ভাব। গলার সুরে অবহেলা মাখা গাম্ভীর্য্য এনে বলবো,’তোমাকে মনে পরার কি আছে,আমার এত স্মৃতি রোমন্থন করার সময় নেই তো!’ তুমি তখন অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠো,মুখে নামিয়ে এনো অবিশ্বাসের কাল ছায়া; ক্ষাণিকের জন্যে তোমার চোয়াল দুটো যেন লোহার মত শক্ত হয়ে যায়,দৃষ্টিতে ফুঁটে উঠে সুতীব্র ঘৃনা। তারপর তুমি বিষাদে গলে যেও,শ্রাবণের মেঘের মত দুচোখে নামিয়ে এনো বর্ষণ।
জল ছল ছল চোখ দুটি আমার চোখে স্থীর করে অভিমান-অভিযোগ মিশ্রিত প্রশ্ন করো আমাকে,’তবে কেন কথা দিয়েছিলে কখনো ভুলে যাবেনা আমাকে?’ আমারো তখন স্মৃতির স্রোতের করুন দশা,ধৈর্যের মাস্তুলে উপচে পরছে তোলপাড় করা ঢেউ। মনের জাহাজের পালহীন ধাতব শরীরের হাল ধরতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছি বারংবার; অবিরত কাঁপছে আমার ঠোঁট,চোখ ফেঁটে বেরিয়ে আসতে চাইছে রংহীন নুনা রক্তের ধারা। আমি তখন যেন মৃত্যুর মুখোমুখি,পা বাড়ালেই আমার সামনে অভিশাপের চৌকাঠ! তবুও আমি তোমাকে নিরাশ করবো না,উত্তর দিব তোমার প্রশ্নের।
গলা খামছে বের করে আনবো একটা একটা করে শব্দ,বলবো-না তোমাকে আমি মনে রাখিনি; আসলে তোমাকে মনে রাখার কোন প্রয়োজন ই বোধ করিনি এতগুলো জন্ম এবং মৃত্যুকে পেরিয়ে এসেও। তবে কি জানো,আমি না সেই প্রথম জন্মের হাতে গোনা কয়েকটা বিকেলকে ভুলতে পারিনি কখনোই,যে বিকেল গুলো তুমি আমি একসাথে কাটিয়েছিলাম! এত জন্ম এবং জীবনের পাতা উল্টেও সেই জন্মের কিছু বিকেল আমার স্মৃতিতে আজো অমলিন হয়ে আছে,যে রাত গুলো আমি ঘুমহীন পার করে দিয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে;
আমি না কখোনই সেই স্টেশন এর পাশে বসা সুশীতল ছায়ার আদরটাকে ভুলতে পারিনা,যার নিচে বসে তুমি আমি পার করে দিয়েছি কত-শত চৈত্রের দুপুর! শুধু মনে রাখিনি তোমাকে,কারণ তোমার স্মৃতিতে আমি ঘৃনা হয়ে বেঁচে থাকি তেমনটা আমি চাইনি কখনোই! চেয়েছিলাম ভালবাসা করে বাঁচিয়ে রাখতে,কিন্তু তা তুমি চাওনি এই শেষবেলায়! তাই আমি সেই জন্মেই তোমাকে ভুলে গেছি,তবে আজ অব্দী মনে রেখেছি আমার তোমার ভালবাসার স্মৃতি!